2012

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

যেকোন মুসলমানকেই কোরআন এবং হাদিস অনুসরন করতে হবে । কিন্তু কিভাবে ? সেভাবেই যেভাবে কোরআন হাদিসকে অনুসরন করতে বলা হয়েছে । যেভাবে সাহাবীরা, তাবেয়ীরা , তাবে-তাবেয়ীনরা , পূরবর্তী ওলামায় কিরাম অনুসরন করেছেন । যেমন একটি উদাহরন দেয়া যাক । বর্তমানে দেখা যায় অনেকেই সিহাহ সিত্তা বা অন্য কোন হাদিস শরীফের কিতাব পড়ে কোন একটি নতুন হাদিস শরীফ সম্বন্ধে জানল । বিষয়টি হয়ত তার কাছে নতুন অথবা তার প্রতিষ্ঠিত কোনো মতের সাথে সাংঘর্ষিক । এখন সে কি করবে ? যেহেতু এটি সহীহ হাদিস স্বভাবতই সবাই বলবেন এই হাদিস শরীফের ওপরই আমল করা উচিত । আসলেই কি তাই ? আসুন নীচের পরিস্হিতি বিচার বিশ্লেষন করে দেখা যাক :
প্রথম পরিস্হিতি :
হাদিস শরীফ: হযরত হুযায়ফা (রা:) থেকে বর্নিত , তিনি বলেন “রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম একবার এক সম্প্রদায়ের আবর্জনা ফেলার স্হানে গমন করলেন । সেখানে এসে তিনি এর ওপর দাড়িয়ে প্রস্রাব করলেন । …. ( তিরমিযী শরীফ ১৩ নং হাদিস )

এখন মনে করুন আপনি এই হাদিস শরীফ পড়লেন এবং সবাইকে বললেন রসুল (সা:) যেহেতু দাড়িয়ে প্রস্রাব করেছেন এবং এটা সহীহ হাদিস তাই এই হাদিসের ওপর আমল করাতে কোনো অসুবিধা নেই।
এখন কিছুদিন পর আপনি তিরমিজী শরীফ আবার খুলে পড়া শুরু করলেন এবং এই হাদিসটি পেলেন :

হাদিস শরীফ: হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্নিত তিনি বলেন “যে তোমাদের কাছে বর্ননা করবে যে রসুল (সা:) দাড়িয়ে প্রস্রাব করতেন , তোমরা তার কথা বিশ্বাস করবে না । তিনি কেবল বসেই প্রস্রাব করতেন । ( তিরমিযী শরীফ ১২ নং হাদিস )

দ্বিতীয় নং হাদিস শরীফ পড়ে আপনি তো মহা সমস্যায় পড়লেন । কেননা আপনি প্রথম হাদিস শরীফ পড়ে আমল করেছেন এবং আপনার হয়ত আরো বন্ধুদের বলেছেন । কিন্তু দেখা গেলো দুটো হাদিস শরীফ সহীহ হওয়া সত্বেও সাংঘর্ষিক ।
চলুন আমরা দেখি আসলে ব্যাপারটা কি । প্রথম হাদিস শরীফের ব্যাখ্যা হলো রসুলের (সা:) একবার হাটুতে ব্যাথ্যা থাকার কারনে বসতে কষ্ট হচ্ছিল যে কারনে দাড়িয়ে প্রস্রাব করেছিলেন । ( হাকীম এবং বায়হাকীর রেওয়ায়েতে এটা প্রমান হয় )

কিন্তু রসুলের (সা:) সবসময়ের আমল এটা ছিল না । দুটো হাদিসের মধ্যে আসলে কোনো বিরোধ নেই । কিন্তু সমস্যা তখনই হবে যখন একটি হাদিস পড়ে এবং এ বিষয়ের অন্য হাদিস না পড়ে , ব্যাখ্যা শানে নজুল না জেনে , আলেমদের সাথে পরামর্শ না করেই আমল করা শুরু করব । সমস্যা এখানেই ।
আমি আরো কিছু পরিস্হিতির উল্লেখ করব যে সব ক্ষেত্রে সরাসরি হাদিস অনুসরন করলে বিপদ হতে পারে : যেমন:

দ্বিতীয় পরিস্হিতি : আপনি কোনো সহীহ হাদিস পেলেন , যেটাতে নামাজে কথা বলা যায় এমন ঘটনা বর্ননা করা আছে । কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এই হুকুম এখনও বলবৎ আছে । কেননা অন্যন্য হাদিস শরীফ দ্বারা আমরা জানতে পারি এই হুকুম পরবর্তিতে মনসুখ ( বা রহিত ) হয়ে গেছে ।

উদাহরন দেয়া হলো:

হাদিস শরীফ: জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) থেকে বর্নিত , তিনি বলেন , রসুলুল্লাহ (সা:) আমাকে একটি কাজে পাঠিয়েছিলেন । আমি ফিরে এসে দেখি , তিনি (সওয়ারীতে আরোহন করে নফল) সালাত আদায় করছেন আমি ( ঐ অবস্হায়) তাকে সালাম দিলাম । তিনি ইংগিতে আমাকে চুপ করতে বললেন । তারপর সালাত শেষ করে আমাকে ডাকলেন এবং বললেন , তুমি এক্ষুনে আমাকে সালাম দিয়েছিলে অথচ আমি সালাতরত ছিলাম । বর্ননাকারী বলেন , তিনি এই সময় পূর্বমুখী ছিলেন । ( মুসলিম শরীফ : ১০৮৬ )
দেখুন এখানে কিন্তু রসুলুল্লাহ (সা:) নামাজের মধ্যেই ইশারাতে তাকে চুপ করতে বললেন ।

এবার এই হাদিসটি দেখুন :

হাদিস শরীফ: যায়দ ইবনে আরকাম (রা:) থেকে বর্নিত যে , তিনি বলেন , আমরা সালাতে কথাবার্তা বলতাম , প্রত্যেকেই তার পাশের ব্যক্তির সাথে আলাপ করত । অত:পর যখন “ওয়া কুমু লিল্লাহি কনিতিন” ( আল্লাহর জন্য দাড়াবে বিনীতভাবে ) ( ২:২৩৮) আয়াতটি নাযিল হোলো , তখন আমাদেরকে চুপ থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং পরস্পরে আলাপ করতে নিষেধ করা হয় ।

এছাড়া আরো অনেক হুকুম আছে যেটা আগে নামাজে ছিল পরবর্তিতে নিষেধ করা হয় । যেমন থুথু ফেলা । প্রথমদিকে নামাজ পড়া অবস্হায় বাম দিকে থুতু ফেলা যেত ।

তৃতীয় পরিস্হিতি : এমনও হতে পারে কোনো সহীহ হাদিস দুরকম ব্যাখ্যা হয় এবং দুটোই সঠিক
দেখুন:
রসুলুল্লাহ (সা:) একবার একদল মুসলমানকে নিম্নোক্ত নির্দেশসহ প্রেরন করলেন “বনু কুরায়জায় পৌছে সালাত আদায় করবে” । তার এই আদেশকে শাব্দিক অর্থে গ্রহন করে দলের কিছু সাহাবী নির্ধারিত সময় আসর সালাতের জন্য না থেমে প্রায় সুর্যাস্হ পর্যন্ত সফর অব্যাহত রাখেন এবং বনু কুরায়জায় গিয়ে আসরের সালাত আদায় করেন । আবার কিছু সংখ্যক লোক যারা রসুলের (সা:) আদেশের শাব্দিক অর্থ গ্রহন না করে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুসরন করতে গিয়ে বনু কোরায়জায় পৌছার পূর্বে স্বল্প সময়ের জন্য বিরতি করে আসেরর সালাত আদায় করেন । রসুল (সা:) এর নিকট উভয় দলের ঘটনা বর্ননা করা হলে তিনি বলেছিলেন , উভয়ই সঠিক ।
এই হাদিস দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম কিছু ক্ষেত্রে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের দুটি সমাধান হতে পারে যার দুটোই সঠিক । এবং এটাকে আপনি কিয়াসও বলতে পারেন । দুই দল সাহাবী রসুলের (সা:) বক্তব্যের ওপর কেয়াস করেছিলেন এবং দুটোই সঠিক ছিল । ( তবে এমন কিয়াস করতে পারেন শুধু মুজতাহিদগন , আমাদের মত আমজনতা নন )

৪র্থ পরিস্হিতি : এমনো হতে পারে কোনো হাদিসে কোনো একটি কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে , আপনি হয়ত ভাবলেন সেটা সবার জন্য , চিরকালের জন্য নিষেধ । কিন্তু গবেষনা করে দেখা গেল সেটা আসলে সেই ব্যক্তির জন্য এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিষিদ্ধ , পরবর্তিকালে সবার জন্য সেটা নিষেধ নয় । ( নির্দিষ্ট কিছু সাহাবীকে হাদিস সংকলন করতে নিষেধ করা এই বিষয়ের মধ্যে পড়বে ) ।
প্রথম হাদিস শরীফ (হাদিস বিষয়ে লিখতে নিষেধ করা ): রসুলুল্লাহ (সা:) বলেন “আমার নিকট হতে কোরআন ব্যতীত তোমরা অন্য কিছু লিখবে না । যে ব্যক্তি আমার নিকট হইতে কোরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিখিয়াছে সে যেন তাহা মুছিয়া ফেলে । ( মুসলিম, মোকদ্দামা )

দ্বিতীয় হাদিস শরীফ ( হাদিস বিষয়ে লিখতে বলা ) : কোনো কোনো সাহাবার নিকট ক্ষুদ্র পুস্তিকা ছিল হাদিসের সংকলন । আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আসের হাদিস এর পুস্তকখানি এক দৃষ্টান্ত । তিনি তার বই এর নাম রেখেছিলেন “আস সাদিকাহ” । কোনো কোনো সাহাবার দৃষ্টি আবদুল্লাহ ইবনে আমরের বই এর প্রতি পড়ল । তারা বলল , রসুল (সা:) যা কিছু বলেছেন তা আপনি লিখে রাখছেন ? রসুলল্লাহ (সা:) রাগান্বিত হলে এমন কিছু বলেন যা সাধারনত শরীয়ত বলে গ্রহন করা চলে না । অত:পর ইবনে আমর বিষয়টি রসুলের (সা:) কে বললেন । রসুলুল্লাহ (সা:) বলেন “আমার থেকে যা শ্রবন কর তা লিখে রাখ । ঐ পবিত্র সত্বার শপথ যার হাতে আমার জীবন আমার মুখ থেকে হক ব্যতীত কিছুই বের হয় না ।
প্রথম হাদিস শরীফে লিখতে নিষেধ করা হয়েছে , আর দ্বিতীয় হাদিস শরীফে লিখতে বলা হয়েছে । এর ব্যাখ্যায় আলেমগন বলেন

** অধিকাংশ আলেমগন বলেন অনুমতি দ্বারা নিষেধাজ্ঞা রহিত হয়ে গেছে ।

** কিছু কিছু আলেম বলেন নিষেধাজ্ঞা ছিল তাদের জন্য যাদের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা ছিল তারা “কোরআন” এবং “হাদিস” মিশিয়ে ফেলতে পারেন , কিন্তু যাদের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা ছিল না তাদেরকে নিষেধ করা হয়নি।

সূত্র :
১। ইসলামি শরীয়াহ ও সুন্নাহ : মুস্তফা হোসন আস সুবায়ী
২। হাদিসের তত্ব ও ইতিহাস : নুর মোহাম্মদ আজমী

৫ম পরিস্হিতি : কোনো একটি আমল এর ক্ষেত্রে আপনি একটি হাদিস পেলেন যেটা জঈফ , এর ভিত্তিতে আপনি ধারনা করলেন এই আমল করা ঠিক হবে না । কিন্তু এমনও দেখা গেছে ( এবং অনেক ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য ) একই “আমলের” বিষয়ে একটি জঈফ হাদিস আছে এবং আরো অনেক সহীহ হাদিস আছে । সুতরাং এই “জঈফ” হাদিসের কারনে এই আমল বাতিল হবে না , যেহেতু এর সাথে সংশ্লিষ্ট আরো সহীহ হাদিস আছে।

৬ষ্ঠ পরিস্হিতি : আবার এমনও দেখা গেছে কোন একটি বিষয়ে শুধুমাত্র “জঈফ” হাদিস আছে । কোনো সহীহ হাদিস নেই । কিন্তু দেখা গেছে “সাহাবীদের (রা:) ” মধ্যে এই আমল প্রচলিত আছে । এতে মুজতাহিদ ঈমামগন বা যারা ফকীহ তারা সিদ্ধান্তে এসেছেন এই আমল নিশ্চয়ই রসুলুল্লাহ(সা:) থেকে এসেছে যেহেতু সাহাবীদের মধ্যে এটা এখনও প্রচলিত আছে। তাই রাবীর কারনে হাদিসটি জঈফ হতে পারে কিন্তু হাদিসটির মুলত গ্রাউন্ড আছে। এবং এই পরিস্হিতিতে এই জঈফ হাদিসের উপর বেস করে আমলটি সম্পূর্ন গ্রহনযোগ্য । সুতরাং এতে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি , জঈফ হাদিস দেখে কেউ যদি বলে এর ওপর আমল করা যাবে না তাহলে সবসময় সেটা সত্য নাও হতে পারে । যেহেতু সাপোর্টিং হিসেবে সাহাবীদের মধ্যে এই আমল প্রচলিত আছে ( যেটাকে কেউ হাদিস বা কেউ “আছারে সাহাবা” বলে থাকেন )।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে “সহীহ হাদিস হলেও সেটা পড়ে সাথে সাথে বিচার বিশ্লেষন না করে অনুসরন করলে বিপদের সম্ভাবনা আছে” । সহীহ হাদিস হলেই সেটা সরাসরি অনুসরন করা যায় না । হাদিস অনুসরন করার এটা পদ্ধতি নয় ।এটা হাদিস অনুসরন করার “বেদআতি পন্হা” । কোনো বই এ সহীহ হাদিস উল্লেখ করে মাসআলা দেয়া থাকলে বলা যাবে না সেটা সহীহ বা সেই বই এর সব মাসআলা বিশুদ্ধ । কেননা এমনও হতে পারে উপরের সমস্যা গুলো লেখক বা গবেষক খতিয়ে দেখেননি ।

বর্তমান কিছু সমস্যার পর্যালোচনা :

আজকাল অনেক সময়ই দেখা যায় কেউ কেউ কোনো একটি হাদিস গ্রন্হ পড়ে একটি হাদিস দেখলো যেটা প্রচলিত “মাজহাবের” আমলের বিপরীত । সাথে সাথে তারা সিদ্ধান্ত আসে “সহীহ হাদিসের ওপর আমল করতে হবে , মাজহাবের এই আমল যেহেতু সহীহ হাদিসের বিপরীত তাই এটা অনুসরন করা যাবে না” । । তাদেরকে আমার কিছু প্রশ্ন :
১) আপনি কি ১০০% নিশ্চিত যে মাজহাবের এই আমলের দলীল সাপেক্ষে সহীহ হাদিস নেই ?
২) আপনার কাছে কি এই নির্দিষ্ট আমল সংক্রান্ত পৃথিবীর সমস্ত হাদিস কালেকশনে আছে , যার ভিত্তিতে আপনি বলতে পারেন মাজহাবের এই আমলের সাপোর্টিং কোনো সহীহ হাদিস নেই ?
৩) আপনি কি নিশ্চিত মাজহাবের এই আমলের সাপোর্টিং হিসেবে সাহাবীদের কোনো আমলে নেই ?
৪) আপনি যে হাদিসকে সহীহ বলছেন সেটা পরবর্তিকালে “রহিত/মনসুখ” হয়নি এ বিষয়ে কি আপনি নিশ্চিত ?
উপরের প্রশ্নগুলো নিজেকে করুন , তাহলে আপনা-আপনিই এর সমাধান পেয়ে যাবেন । এমন অনেক পরিস্হিতি হতে পারে যেগুলোর সমাধান এত সহজে করা যায় না ।
সাহাবীগন , তাবেয়ীন , তাবে-তাবেয়ীন , সলফে সালেহীনগন এভাবে হাদিস অনুসরন করেননি । এখন প্রশ্ন হতে পারে তাহলে কিভাবে ওনারা হাদিস অনুসরন করেছেন ? ওনারা কিভাবে অনুসরন করেছেন সেটা আজকের পোস্ট এর বিষয় না ।
আজকের পোস্টের বিষয় হোলো সরাসরি হাদিস অনুসরন করার যে পন্হা বর্তমানে চলছে সেটা ভুল পন্হা ।
আহলে হাদিস নাম দিলেই বলা যাবে না তারাই একমাত্র “হাদিস” প্রকৃতভাবে অনুসরন করছে । বরং সুন্নত সিস্টেম সেটাই যেভাবে সাহাবীগন , তাবেয়ীগন এবং আগেকার সলফে সালেহীনগন হাদিস অনুসরন করেছেন , যেটা অন্য পোস্টে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ ।
ওয়াস সালাম

[ সূত্র: এই পোস্ট লেখার সময় যেসকল বই এর সাহায্য নেয়া হয়েছে ]
১। দরসে তিরমিজী : মাওলানা তকী ওসমানী
২। মুসলিম শরীফ
৩। মাজহাব কি ও কেনো : মাওলানা তকী ওসমানী
৪। ইসলামি উসূলে ফিকাহ : দ: তাহা জাবীর আল আলওয়ানী

আহলে হাদীস দলের সংজ্ঞাতেই প্রতারণা
যে দলের রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে ইংরেজদের কাছ থেকে সে দলের সংজ্ঞার মাঝে ধোঁকাবাজী ও প্রতারণা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ওদের সংজ্ঞার মাঝেই ধোঁকাবাজী আছে এটা বুঝার সহজ পদ্ধতি হল-
আপনি তাদের জিজ্ঞেস করুন-আহলে হাদীস কাকে বলে?
ওরা বলবে-কুরআন ও সহীহ হাদীস মানার নাম আহলে হাদীস।
তাহলে কি দাঁড়াল? যারা কেবল কুরআন ও সহীহ হাদীস মানে তাদের বলা হয় আহলে হাদীস। মানে তারা কোন ব্যক্তির অনুসরণ [যার আরবী হল তাক্বলীদ] করে না।
এবার তাদের জিজ্ঞেস করুন-কোন হাদীসকে আল্লাহ তায়ালা সহীহ বা দুর্বল বলেছেন কুরআনে? বা নবীজী সাঃ কোন হাদীসকে সহীহ বা দুর্বল বলেছেন হাদীসে?
ওরা বলবে-না বলেন নি।
আপনি তখন তাদের বলুন-হাদীস সহীহ বা দুর্বল হওয়ার বিষয় যেহেতু আল্লাহ ও বলেননি, নবীজী সাঃ ও বলেননি তাই তারা নিজেরা হাদীসকে সহীহ বা দুর্বল বলে আহলে হাদীস হওয়া থেকে বের হয়ে যায়। কারণ তারা না আল্লাহ, না নবী। তাদের কোন অধিকার নেই কোন হাদীসকে সহীহ বা দুর্বল বলা। যেহেতু কেবল কুরআন ও সহীহ হাদীস মানার নাম হল আহলে হাদীস। আর কুরআনে কোন হাদীসকে সহীহ বা দুর্বল বলা হয়নি। সেই সাথে হাদীসেও নবীজী সাঃ কোন হাদীসকে সহীহ বা দুর্বল বলেননি। তাই কোন হাদীসকে সহীহ বা দুর্বল বলার মানেই হল এরা নিজেদের হয়তো আল্লাহ নয়তো নবী দাবি করছে। যদি বলে আল্লাহ বা নবী দাবি করেনা, বরং সহীহ বা দুর্বল বলে থাকে হাদীস বিশারদ মুহাদ্দিসদের বক্তব্যের আলোকে। তাহলেও তারা আর আহলে হাদীস থাকে না।
কারণ মুহাদ্দিসীনদের কথা মানা, মানেই হল অনুসরণ করা যাকে আরবীতে বলা হয় তাক্বলীদ। আর তাক্বলীদ হল ওদের ভাষায় শিরক। মুহাদ্দিসীনদের কথা মানা মানেই অনুসরণ তথা তাকলীদ। আর তাক্বলীদ করার মাধ্যমে তারা নিজেদের বক্তব্য অনুযায়ী শিরকী কাজ করে। অথবা সেই মুহাদ্দিসকে আল্লাহ বা নবী [নাউজুবিল্লাহ] দাবি করে। দাবি যদি না করে তাহলে তারা কিছুতেই স্বীয় সংজ্ঞা অনুযায়ী আহলে হাদীস থাকতে পারে না। হয়তো নিজেকে আল্লাহ বা নবী দাবিদার হয় [নাউজুবিল্লাহ], নতুবা মুহাদ্দিসীনদের তাক্বলীদ করে হয় ওদের ভাষায় শিরককারী, কিংবা মুহাদ্দিসীনদেরই আল্লাহ বা নবী দাবিদার হবে [নাউজুবিল্লাহ]।
সুতরাং ওরা মুখে কুরআন ও সহীহ হাদীস মানার কথা বললেও তারা নিজেদের এ দাবিতে হাদীসের প্রকারভেদ ও সংজ্ঞাতেই ঠিক থাকতে পারে না। অথচ সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের অনুসরণ করা ছাড়া শুধু কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর আমল করার প্রচারণা করে একটি মিথ্যা ও প্রতারণামূলক মতবাদের দিকেই আহবান করে।

যাচাই বাছাই ছাড়া আহলে হাদীস মতবাদের দিকে আহবানকারী নবীর হাদীস অনুযায়ী মিথ্যাবাদী
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ (سنن ابى داود-كتاب الأدب، باب فِى التَّشْدِيدِ فِى الْكَذِبِ، رقم الحديث-4994)
অনুবাদ-হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-যা শুনে তা’ই বলতে থাকা [যাচাই বাছাই ছাড়া] ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ঠ। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৯৯৪, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৩০, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৭, মুসনাদে ইবনুল জিদ, হাদীস নং-৬২৭, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৮২০১, মুসনাদুশ শিহাব, হাদীস নং-১৪১৫, মাশকিলুল আসার লিত তাহাবী, হাদীস নং-১৯৮০, মুসনাদে আব্দুল্লাহ বিন মুবারক, হাদীস নং-১৯, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-২৬১৩১}
সুতরাং যেসব আহলে হাদীস মতাদর্শীরা তাদের আহলে হাদীস হওয়ার সংজ্ঞার এ ধোঁকাবাজী সম্পর্কে যাচাই বাছাই ছাড়াই নিজেদের মতবাদের দিকে সরলপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য ডাকে ওরা নবীজী সাঃ এর হাদীসের ভাষায় মিথ্যাবাদী।

আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী তাক্বলীদের পর্যায়
আমাদের আক্বিদা হল সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহই অনুসরণীয় সেসব ক্ষেত্রে যেসব ক্ষেত্রে কুরআন হাদীসের বর্ণনা সুষ্পষ্ট। তাতে কোন প্রকার অস্পষ্টতা নেই। সাথে সাথে পরস্পর বিরোধী কোন বর্ণনা হাদীসে বা কুরআনে নেই। সেসব ক্ষেত্রে কারো তাকলীদ করা জায়েজ নয়। আমরা সেসব ক্ষেত্রে কারো তাকলীদ বা অনুসরণ করিও না। যেমন নামায ফরয, রোযা ফরয, হজ্ব ফরজ ইত্যাদী।
কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে আয়াত বা হাদীসের অর্থ বোধগম্য নয় কঠিন। বা পরস্পর বিরোধী বর্ণনা হাদীসে এসেছে। যেমন ইমামের পিছনে মুক্তাদী কিরাত পড়বে কি না? আমীন জোরে বলবে না আস্তে বলবে? সেসব ক্ষেত্রে নবীজী সাঃ এর বলা শ্রেষ্ঠ যুগের কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে বিজ্ঞ মুজতাহিদ ব্যক্তির ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন সুন্নাহর উপর আমল করি। যে মুজতাহিদদের ক্ষেত্রে আল্লাহর নবী বলেছেন-
عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ فَأَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ فَأَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ
হযরত আমর বিন আস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-“যখন কোন বিশেষজ্ঞ হুকুম দেয়, আর তাতে সে ইজতিহাদ করে তারপর সেটা সঠিক হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে দু’টি সওয়াব। আর যদি ইজতিহাদ করে ভুল করে তাহলে তার জন্য রয়েছে একটি সওয়াব। {সহীহ বুখারী, হাদিস নং-৬৯১৯, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৫৭৬, সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-৪৫৮৪}
তারা ভুল করলেও এক নেকি পাবে, আর সঠিক করলে ডাবল নেকি তাদের ব্যাখ্যাকে অনুসরণ করি। ব্যক্তিকে অনুসরণের জন্য নয়, বরং তিনি কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে বিজ্ঞ হওয়ার কারণে, এবং নবীজী সাঃ এর বলা শ্রেষ্ঠ যুগের ব্যক্তিত্ব হওয়ায় নিজের ইচ্ছা ও বুঝের উপর নির্ভর না করে বিজ্ঞ ব্যক্তির ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন সুন্নাহর উপর আমল করি।

অন্ধ তাক্বলীদ কাকে বলে?
আজ কালের কিছু লোক এই অপবাদ ছড়ায় যে, এটাতো অন্ধ তাকলীদ।
আফসোস! এই বেচারারা অন্ধ তাকলীদের অর্থও জানেনা। অন্ধ তাকলীদ এটাকে বলে, যেখানে অন্ধ অন্ধের পিছনে চলে। তখন উভয়ে কোন গর্তে নিপতিত হয়। এটা অন্ধ তাকলীদ। আর যদি অন্ধ দৃষ্টিবান মানুষের পিছনে চলে, তো এই দৃষ্টিবান ব্যক্তি এই অন্ধকেও তার চোখের বরকতে সকল গর্ত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে। আর মানজিলে মাকসাদে পৌঁছিয়ে দিবে।
আইয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন (নাউজুবিল্লাহ) অন্ধ নয়। তারা দৃষ্টিবান। তারা কুরআন সুন্নাহ ও সাহাবাদের ফাতওয়া ও জীবনাচার সম্পর্কে, সেই সাথে আরবী ভাষাসহ ইলমী সকল বিষয়ে প্রাজ্ঞ।
তবে অন্ধ ব্যক্তি আছে। আছে অন্ধ মুকাল্লিদও। যারা নিজেরাও অন্ধ। তাদের পথিকৃত ও অন্ধ। অর্থাৎ তাদের ইজতিহাদের চোখ নাই। এই জন্যই নবীজী সাঃ বলেছেন যে, যে মুর্খকে দ্বীনের পথিকৃত বানায়, সেই মুর্খ নিজেও গোমড়া হয়, আর তার অনুসারীদেরও গোমড়া করে। এর নাম অন্ধ তাকলীদ।
আল্লাহ তায়ালা নিষ্পাপ নবী সাঃ আর পূণ্যবান মুজতাহিদীনদের গবেষণা-সম্পাদনার উপর আমলে করার তৌফিক দান করুন। আর নব্য নব্য ফেতনা থেকে হিফাযত করুন।

তাক্বলীদের অস্বিকারকারীরা নিজেদের পিতার পরিচয় পেতে পারে না
তাক্বলীদ মানেই হল বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে মানা। যাকে যে বিষয়ে প্রাজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি মনে হয় তাকে মানার নামই তাক্বলীদ। কথিত আহলে হাদীস গোষ্ঠি যেহেতু বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির তাক্বলীদকে শিরক বলে তাই তারা নিজেদের পিতাকে পিতা বলতে পারবে না। কারণ পিতা কে? এটা জানার জন্য মায়ের উপর বা কাছের আত্মীয় স্বজনের কথার তাক্বলীদ করতে হয়।
যেহেতু মায়ের কথা ছাড়া ও স্বীকারোক্তিকে বিশ্বাস ও মানা তথা তাক্বলীদ করা ছাড়া পিতার পরিচয় পাওয়া যায় না, আর আমরা যেহেতু তাক্বলীদকে স্বীকার করি তাই আমরা আমাদের পিতাকে চিনি মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী। মাকে অনুসরণ করে, মাকে বিশ্বাস করে। তাকে বিশ্বাসভাজন মনে করে।
কিন্তু কথিত আহলে হাদীসরা যেহেতু তাক্বলীদকে শিরক বলে। নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির অনুসরণ তথা তাক্বলীদকে মানে না, তাই তারা তাদের পিতার পরিচয় পেতে পারে না। কারণ পিতাকে চিনতে হলে মাকে বিশ্বাস করতে হবে। মায়ের কথার তাক্বলীদ করতে হবে। আর তাক্বলীদ শিরক হওয়ায় তারা তা করতে পারে না। তাই তারা হয়ে যাবে পিতাহীন জারজ।

রাসূল সাঃ এর ছায়া ছিল না মর্মে যে বক্তব্য দেয়া হয়, তা বিশুদ্ধ নয় ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসও সহীহ নয় বরং জাল ভিত্তিহীন
রাসূল সাঃ আমাদের মতই রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন। তারও ঘাম হতো, ছায়া ছিল। ছায়া ছিল না বলাটা রাসূল সাঃ এর জীবনী সাহাবাদের বক্তব্য সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক।
 
রাসূল সাঃ এর ছায়া না থাকা সংক্রান্ত একটি জাল বর্ণনা

اخرج الحاكم الترمذى من طريق عبد بن قيس الزعفرانى عن عبد الملك بن عبد الله بن الوليد عن ذكران ان رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يكن يرى له ظل فى شمس ولا قمر، ذكره السيوطى فى “الخصائل الكبرى-1/122)
অনুবাদ-যাকওয়ান থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-সূর্য চাঁদের আলোতে রাসূল সাঃ এর ছায়া দেখা যেতো না। {আল খাসায়েলুল কুবরা-/১২২}

জবাব

বর্ণনাটি জাল ভিত্তিহীন। কেননা, প্রথমত তার সূত্রে রয়েছে আব্দুর রহমান বিন কাইস যাফরানী, যার সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের কঠোর মন্তব্য রয়েছে।
বিজ্ঞ রিজাল শাস্ত্রবীদ আব্দুর রহমান বিন মাহদী এবং ইমাম আবু যরআ রহঃ তাকে মিথ্যুক বলেছেন।
আবু আলী সালেহ ইবনে মুহাম্মদ রহঃ বলেন-
كلن عبد الرحمن بن قيس الزعفرانى يضع الحديث
তথা আব্দুর রহমান বিন কাইস যাফরানী হাদীস জাল করতো।
এছাড়াও তার সম্পর্কে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ, ইমাম বুখারী রহঃ, ইমাম মুসলিম রহঃ, ইমাম নাসায়ী রহঃ প্রমূখ প্রখ্যাত ইমামদের কঠোর উক্তি রয়েছে।
দ্রষ্টব্য- তারীখে বাগদাদ-১০/২৫১-২৫২, মীযানুল তিদাল-/৫৮৩, তাহযীবুত তাহযীব-/২৫৮
এছাড়া সত্যিই যদি রাসূল সাঃ এর ছায়া না হতো, তাহলে এটি অতি আশ্চর্যজনক বিষয় হওয়ায় অনেক সহীহ হাদীস থাকার কথা। অথচ এমন কোন হাদীস নেই।
তাছাড়া রাসূল সাঃ এর ছায়া আছে মর্মে একাধিক সহীহ হাদীস বিদ্যমান রয়েছে। তাই ছায়া নেই বলাটা অজ্ঞতাসূলভ মন্তব্য ছাড়া কিছু নয়।

রাসূল সাঃ এর ছায়া ছিল মর্মে সহীহ হাদীস

ويئست منه فلما كان شهر ربيع الأول دخل عليها فرأت ظله فقالت إن هذا لظل رجل وما يدخل علي النبي صلى الله عليه وسلم فمن هذا فدخل النبي صلى الله عليه وسلم
এমনকি হযরত যায়নব রাঃ রাসূল সাঃ এর আগমন থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন। রবীউল আওয়ালে তার নিকট যান। ঘরে প্রবেশের প্রক্কালে যয়নব রাঃ তাঁর ছায়া দেখতে পান এবং বলেন-এতো কোন পুরুষ মানুষের ছায়া বলে মনে হয়। তিনিতো আমার কাছে আসেন না। তাহলে ব্যক্তি কে? ইত্যবসরে রাসূল সাঃ প্রবেশ করেন। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৬৮৬৬}

আরো হাদীস-মুস্তাদরাকে হাকীম-/৬৪৮, হাদীস নং-৮৪৫৬


প্রায় দু’শত বছর ইংরেজদের গোলামীতে আবদ্ধ ছিল ভারত উপমহাদেশের সমস্ত মুসলমান। এ দেশের মুসলিম কৃষ্টি-কালচার ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে বিলুপ্ত করে তাদের শাসন-শোষণ স্থায়ী করার হীন প্রচেষ্টায় ইংরেজ বেনিয়ারা বহুমুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কেবল ১৮৫৭ ইংরেজীর আযাদী আন্দোলনে তারা ৫৫ হাজার মুসলমানকে শহীদ করে। ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত ৩ বছরে হিংস্র হানাদাররা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহীদ করে ১৪ হাজার আলেমকে। আগুনে পুড়িয়ে ও গুলি করে শহীদ করে অসংখ্য আলেম-উলামা ও নিরীহ মুসলমানদেরকে। ইজ্জতহরণ ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয় অসংখ্য মুসলিম মা-বোন। কারাবরণ করেন হাজার-হাজার মুসলমান। কেবল দিল্লী শহরেই তারা জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে প্রায় দশ হাজার মাদ্রাসা।
অথচ সেই ইংরেজদের দালালী করেই আজ একটি দল তাদের মনগড়া ইসলাম (!) প্রচারে ব্যস্ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এমন অনেক ভ্রান্ত দলের যারা অনুসরণ করেন, তারা নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। তাই নিম্নে তাদের জন্য কিছু ইতিহাস তুলে ধরা হল, এ থেকে যদি একজন মানুষও উপকৃত হয় তাহলে আমার এই পোস্ট স্বার্থক হবে বলে আমি মনে করি।

ইতিহাসের পাতায়ঃ

১।
“ মুযাহেরে হক্ব ” কিতাবের স্বনামধন্য লেখক মাওলানা “ কুতুব উদ্দীন ” তাঁর “ তুহ্ফাতুল আরব ওয়াল আযম ” গ্রন্থে গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, যার সার-সংক্ষেপ নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
“ সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ, মাওলানা ইসমাইল শহীদ ও মাওলানা আব্দুল হাই (রহঃ) পাঞ্জাবে আগমন করার পরপরই কতিপয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীর সমন্বয়ে চার মায্হাবের ইমামগণের তাক্বলীদ অস্বীকারকারী নতুন ফিরক্বাটির সূত্রপাত লক্ষ্য করা যায়, যারা হযরত সাইয়্যেদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) এর মুজাহিদ বাহিনীর বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্য ছিল, এদের মূখপাত্র ছিল মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী (মৃত-১২৭৫হিঃ)। তার এ ধরণের অসংখ্য ভ্রান্ত কর্মকান্ডের কারণে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রহঃ) ১২৪৬ হিজরীতে তাকে মুজাহিদ বাহিনী থেকে বহিষ্কার করেন। তখনই গোটা ভারতবর্ষের সকল ধর্মপ্রাণ জনগণ, বিশেষ করে সাইয়্যেদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) এর খলিফা ও মুরীদগণ হারামাইন শরীফাইনের তদানীন্তন উলামায়ে কিরাম ও মুফতীগণের নিকট এ ব্যাপারে ফত্ওয়া তলব করেন। ফলে সেখানকার তৎকালীন চার মায্হাবের সম্মানীত মুফতীগণ ও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে মৌঃ আব্দুল হক্ব ও তার অনুসারীদেরকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ফিরক্বা বলে অভিহিত করেন এবং মৌঃ আব্দুল হক্বকে ক্বতল (হত্যা) করার নির্দেশ প্রদান করেন।
(এ ফতওয়া ১২৫৪ হিজরীতে তান্বীহুদ্দাল্লীন নামে প্রকাশ করা হয়, এখনো দেশের বিশিষ্ট লাইব্রেরীতে এর কপি সংরক্ষিত রয়েছে।)
মৌঃ আব্দুল হক্ব বেনারস পলায়ন করতঃ কোনভাবে আত্নরক্ষা পায়। সেখানে গিয়ে তার নবাবিষ্কৃত দলের প্রধান হয়ে সরলমনা জনসাধারণের মধ্যে তার বিষাক্ত মতবাদ ছড়াতে থাকে।”
(তুহ্ফাতুল আরব ওয়াল আযমঃ পৃঃ ১৬ খঃ ২, আল-নাজাতুল কামেলাঃ পৃঃ ২১৪, তান্বীহুদ্দাল্লীন, পৃঃ ৩১)
উপরোক্ত বিবরণ থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, মৌঃ আব্দুল হক্ব বেনারসী কর্তৃক ১২৪৬ হিজরীতে ভারতবর্ষে গাইরে মুক্বাল্লিদ তথা লা-মায্হাবী নামক নতুন ফিরক্বাটির সূত্রপাত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে সে “ ওহ্হাবী ” হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সে নিজেকে “ মুহাম্মদী ” বলে প্রচার করতো। পরবর্তীতে “ ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম ” এ মর্মে ফত্ওয়া দিয়ে ইংরেজের দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়। এবং এ সুযোগে সে সরকারী কাগজ-পত্র থেকে “ ওহ্হাবী ” নাম রহিত করে আহ্লে হাদীস নাম বরাদ্দ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নবোদ্ভাসিত এ ফিরক্বাটিই আজ নিজেদের ব্যতীত অন্যান্য সবাইকে নবোদ্ভাসিত বা বিদ্য়া’তী বলে অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে। এটা সত্যিই দুঃখজনক নয় কি !

২।
এ মর্মে তাদের দলেরই অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও পরিচালক নবাব ছিদ্দীক্ব হাসান খানের কয়েকটি উক্তি আমাদের বক্তব্যের পক্ষে সাক্ষ্য বহন করে, যেমন তার রচিত গ্রন্থ “ তরজমানে ওহ্হাবিয়্যায় ” তিনি লিখেনঃ
“ আমাদের নতুন মায্হাবে আযাদী (অর্থাৎ তাক্বলীদ না করা) বৃটিশ সরকারী আইনেরই চাহিদা মোতাবেক। ”
(তরজমানে ওহ্হাবিয়্যায়ঃ পৃঃ ২/৩)

৩।
আহলে হাদীস দলের একাংশের নাম “ গুরাবা আহ্লে হাদীস ”। এ অংশের নেতা মুহাম্মাদ মুবারকের উক্তি হলঃ
“ গুরাবা আহলে হাদীসের ভিত্তি হযরত মুহাদ্দিসীনদের সঙ্গে মতানৈক্য করার জন্যেই রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয় বরং সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রহঃ) এর বিরুদ্ধাচরণ করে ইংরেজদেরকে খুশী করাই ছিল এর বিশেষ উদ্দেশ্য। ”
(উলামায়ে আহ্নাফ আওর তাহরীকে মুজাহিদীনঃ পৃঃ ৪৮)

৪।
ভারতবর্ষে গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের প্রধান মূখপাত্র মিঞা নযীর হুসাইনের অন্যতম শিষ্য অকীলে আহলে হাদীস্ মোলভী মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী লিখেনঃ
“ ঐ আহলে হাদীস দল বৃটিশ সরকারের কল্যাণপ্রত্যাশী, চুক্তি রক্ষাকারী ও অনুগত হওয়ার অত্যন্ত উজ্জ্বল ও বলিষ্ঠ প্রমাণ হলঃ তারা বৃটিশ সরকারের অধীনে থাকা, কোন ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনের থাকার চেয়েও উত্তম মনে করে।”
(আল-হায়াত বা’দা্ল মামাতঃ পৃঃ ৯৩)

৫।
তথাকথিত সেই মোলভী মুহাম্মাদ হুসাইন ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ করার বিপক্ষে “ আল-ইক্বতিছাদ-ফী মাসাইলিল জিহাদ ” নামক গ্রন্থ রচনা করে, যাতে সে জিহাদ “ মান্ছুখ ” বা রহিত বলে ঘোষণা করে। এর ফলশ্রুতিতে সে ইংরেজের বিশ্বস্ত ও ভাড়াটে গোলামে গণ্য হয়। আর লাভ করে টাকা-পয়সার বিরাট অংক।
(হিন্দুস্থান কী পহলী ইসলামী তাহরীকঃ পৃঃ ২১২, আহলে হাদীস আওর ইংরেজঃ পৃঃ ৮৭)

৬।
তাইতো তারই বিশিষ্ট শিষ্য মৌলভী আলতাফ হুসাইন লিখেনঃ
“ হিন্দুস্তানে ইংরেজী গভার্মেন্ট আমরা মুসলমানদের জন্য খোদার রহমত। ”
(আল-হায়াত বা’দাল মামাতঃ পৃঃ ৯৩)
সম্মানিত পাঠক সমাজ! ইংরেজ আমলে ইসলাম ও মুসলমান্দের দুরবস্থার করুণ কাহিনী বলার অপেক্ষা রাখে না, যেদিন সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকার এদেশের হাজার হাজার আলিম-উলামা ও মহামনীষীদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছিল, আর দ্বীপান্তরের কঠিন বন্দিশালায় নিক্ষেপ করেছিল লক্ষ লক্ষ তৌহিদী জনতাকে। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিল ইয্যতহারা মা-বোনদের গগন-বিদারী আর্তনাদে। জ্বালিয়ে দিয়েছিল হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসা আর ভস্মীভূত করেছিল লক্ষ কোটি কুরআন-কিতাব, তখনই হযরত শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দীসে দেহলভী (রহঃ) কর্তৃক দৃপ্তকন্ঠে ঘোষিত হল জিহাদের ফত্ওয়া, এ ফাত্ওয়ার বলে উলামায়ে কিরাম ও সমগ্র তৌহিদী জনতা ঝাপিয়ে পড়েন আযাদী আন্দোলনের জিহাদে। শহীদ হন হাজার হাজার বীর মুজাহিদ। আর ঠিক এমনি এক করুণ মুহূর্তে “ আহলে হাদীস ” নামধারী দলটি সেই ইংরেজ সরকারকে “ খোদার রহমত ” বলে আখ্যায়িত করে, আর তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ হারাম বলে ফাত্ওয়া দিয়ে হালুয়া-রুটির সুব্যবস্থা করে। তারা কি মুসলমান ? তারা কী চায়? কী তাদের উদ্দেশ্য? কোথায় তাদের গন্তব্য?
উপরোক্ত তথ্যাবলী থেকে একথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষে মুসলমানদেরকে দ্বিধা বিভক্ত করতঃ তাদের আধিপত্য মজবুত ও বিস্তার করার মানসে যে সমস্ত হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল, এরই ফলশ্রুতিতে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল কাদিয়ানী, বেরলভী ও তথাকথিত “ আহলে হাদীস ” তথা “ লা-মায্হাবী ” দল সে দিনের ঐ বৃটিশ জালিম তল্পীবাহকদেরই উত্তরাধিকারী ও দোসর।

৭।
ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, ১২৪৬ হিজরীর পর এই উপমহাদেশে সৃষ্ট বিদ্‌য়া’ত ও নতুন ফিরক্বাটিকে মুসলমানগণ যখন ওহ্‌হাবী বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন তখন তারা নিজেদেরকে মুহাম্মাদী বলে দাবী করে। সে হিসেবে মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী ও মৌঃ নজীর হুসাইন ভারতবর্ষের প্রথম মুহাম্মাদী নামের দাবীদার। অনুরূপ ভাবে তাদের তদানীন্তন অনুসারীরাও মুহাম্মাদী নামেই আত্নপ্রকাশ করতো। এ ধারায় নবাব ছিদ্দিক্ব হাসান খান ১২৮৫ হিজরীতে মৌঃ আব্দুল হক্ব বেনারসী থেকে লিখিত ভাবে মুহাম্মাদী উপাধি লাভ করেন।
( মায্‌হাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহঃ পৃ – ৩৬ )

৮।
বর্তমানে অবশ্য গাইরে মুক্বাল্লিদরা ওহ্‌হাবী বা সালাফী নামে আত্নপ্রকাশ করে সউদী রিয়াল, দিনার, দিরহাম উপার্জনের মোহে ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু ১২৪৬ হিজরীতে, তাদের উদ্ভবের সূচনালগ্নে যখন তেল পেট্রোলের পয়সার জমজমাট ছিল না, ওহ্‌হাবীদেরই যখন দুর্দিন দুর্ভিক্ষ চলছিল, বিশেষ করে ভারতবর্ষে ইংরেজ-বিরোধী ও ইংরেজ বিতাড়নের জিহাদে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদেরকে ইংরেজ সরকার ওহ্হাবী বলে আখ্যায়িত করেছিল, তখন গাইরে মুক্বাল্লিদরা ওহ্হাবী নামের আখ্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাই তারা তখন নিজেদের জন্য “ মুহাম্মদী ” এবং পরবর্তীতে “ আহলে হাদীস ” নাম বরাদ্দ করার সম্ভাব্য সকল অপতৎপরতা চালিয়ে গিয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের তৎকালীন অন্যতম মুখমাত্র মৌলভী মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী লাহোরী বৃটিশ সরকারের প্রধান কার্যালয় এবং পাঞ্জাব, সি-পি, ইউ-পি, বোম্বাই, মাদ্রাজ ও বাঙ্গালসহ বিভিন্ন শাখা অফিসে ইংরেজ প্রশাসনের আনুগত্যতা ও বশ্যতা স্বীকার করত: তাদের জন্য “ আহ্লে হাদীস ” নাম বরাদ্দ দেয়ার দরখাস্ত পেশ করেন। এ দরখাস্তগুলোর প্রতি উত্তর সহ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত তৎকালীন “ এশায়াতুস সুন্নাহ ” পত্রিকায়ও প্রকাশ করা হয় যা পরে সাময়ীক নিবন্ধ আকারেও বাজারজাত করা হয়।
( এশায়াতুস সুন্নাহঃ পৃ: ২৪-২৬, সংখ্যা: ২, খ: ১১)

তাদের মানসিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিছুটা আঁচ করার জন্য পাঠক সমীপে তন্মধ্য হতে একটি দরখাস্তের অনুবাদ নিম্নে পেশ করছিঃ

“বখেদমতে জনাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী,
আমি আপনার খেদমতে লাইন কয়েক লেখার অনুমতি এবং এর জন্য ক্ষমাও পার্থনা করছি। আমার সম্পাদিত মাসিক “ এশায়াতুস সুন্নাহ ” পত্রিকায় ১৮৮৬ ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলাম যে, ওহ্হাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমক হারাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার সমীচিন হবে না, যাদেরকে “ আহ্লে হাদীস ” বলা হয় এবং যারা সর্বদা ইংরেজ সরকারের নিমক হালালী, আনুগত্যতা ও কল্যাণই প্রত্যাশা করে, যা বার বার প্রমাণও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি প্রত্রে এর স্বীকৃতিও রয়েছে।
অতএব, এ দলের প্রতি ওহ্হাবী শব্দ ব্যবহারের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং সাথে সাথে গভার্মেন্টের বরাবর অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে আবেদন করা যাচ্ছে যে, সরকারীভাবে এ ওহ্হাবী শব্দ রহিত করে আমাদের উপর এর ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক এবং এ শব্দের পরিবর্তে “ আহ্লে হাদীস ” সম্বোধন করা হোক।
আপনার একান্ত অনুগত খাদেম
আবু সাঈদ মুহাম্মদ হুসাইন
সম্পাদক, এশায়াতুস সুন্নাহ
দরখাস্ত মুতাবেক ইংরেজ সরকার তাদের জন্যে “ ওহ্হাবী ” শব্দের পরিবর্তে “ আহ্লে হাদীস ” নাম বরাদ্দ করেছে। এবং সরকারী কাগজ-চিঠিপত্র ও সকল পর্যায়ে তদের “ আহ্লে হাদীস ” সম্বোধনের নোটিশ জারি করে নিয়মতান্তিকভাবে দরখাস্তকারীকেও লিখিতভাবে মঞ্জুরী নোটিশে অবহিত করা হয়।

সর্বপ্রথম পাঞ্জাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী মি: ডাব্লিউ, এম, এন (W.M.N) বাহাদুর চিঠি নং-১৭৫৮ এর মাধ্যমে ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৬ ইংরেজিতে অনুমোদনপত্র প্রেরণ করেন। অতপর ১৪ই জুলাই ১৮৮৮ইং সি,পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৪০৭ এর মাধ্যমে এবং ২০শে জুলাই ১৮৮৮ইং ইউ,পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৩৮৬ এর মাধমে এবং ১৪ই আগষ্ট ১৮৮৮ইং বোম্বাই গভার্মেন্ট চিঠি নং-৭৩২ এর মাধ্যমে এবং ১৫ই আগষ্ট ১৮৮৮ মাদ্রাজ গভার্মেন্ট চিঠি নং-১২৭ এর মাধ্যমে এবং ৪ঠা মার্চ ১৮৯০ইং বাঙ্গাল গভার্মেন্ট চিঠি নং-১৫৫ এর মাধ্যমে দরখাস্তকারী মৌলভী আবু সাইদ মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভীকে অবহিত করা হয়।
( এশায়াতুস সুন্নাহঃ পৃ: ৩২-৩৯, সংখ্যা: ২, খ: ১১)

কোন মুসলিম জামাতের নাম অমুসলিম, মুসলামানদের চিরশত্রু খৃষ্টান নাছারাদের মাধ্যমে বরাদ্দ করার ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বিরল। যা কেবল হিন্দুস্তানী গাইরে মুক্বাল্লিদদেরই গৌরব ও সৌভাগ্যের বিষয় (!) তাই তারা এ ইতিহাসটা অত্যন্ত গৌরবের সহিত নিজেরদের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে তৃপ্তি লাভ করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান

কথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায় প্রচার করে থাকে, আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান নয়। তারা দলিল হিসেবে পেশ করে থাকে সূরা হাদীদের ৩ নং আয়াত। যেখানে ঘোষিত হয়েছে আল্লাহ তায়ালা আরশে সমাসিন। ওরা একটি আয়াত দিয়ে আরো অসংখ্য আয়াতকে অস্বিকার করে নাউজুবিল্লাহ। যেই সকল আয়াত দ্বারা বুঝা যায় আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান।

এক আয়াতকে মানতে গিয়ে আরো ১০/১২টি আয়াত অস্বিকার করার মত দুঃসাহস আসলে কথিত আহলে হাদীস নামী ফিতনাবাজ বাতিল ফিরক্বাদেরই মানায়।
অসংখ্য আয়াতে কারীমাকে অস্বিকার করে আল্লাহ তায়ালাকে কেবল আরশে সীমাবদ্ধ করার মত দুঃসাহস ওরা দেখাতে পারলেও আমরা পারি না। আমরা বিশ্বাস করি-আল্লাহ তায়ালা আরশেও আছেন, আছেন জমিনেও, আছেন পূর্বেও। আছেন পশ্চিমেও। আছেন উত্তরেও। আছেন দক্ষিণেও। উপরেও আছেন। নিচেও আছেন। আল্লাহর গোটা রাজত্বের সর্বত্র তার সত্তা বিরাজমান।

কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকা দেহধারী সত্তার বৈশিষ্ট। আল্লাহ তায়ালার মত নিরাকার সত্তার জন্য এটা শোভা পায় না। এই আহলে হাদীস বাতিল ফিরক্বাটি এতটাই বেয়াদব যে, আল্লাহ তায়ালার দেহ আছে বলে বিশ্বাস করে। দেহ থাকাতো সৃষ্টির বৈশিষ্ট। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সকল সৃষ্টির স্রষ্টার জন্য দেহ সাব্যস্ত করা এক প্রকার সুষ্পষ্ট শিরক। এই শিরকী আক্বিদা প্রচার করছে ইংরেজ সৃষ্ট কথিত আহলে হাদীস সম্র্যদায়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই ভয়াবহ মারাত্মক বাতিল ফিরক্বার হাত থেকে আমাদের দেশের সরলমনা মুসলমানদের হিফাযত করুন। বক্ষমান প্রবন্ধে আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান নিয়ে একটি দলিল ভিত্তিক আলোচনা উপস্থাপন করা হল। পরবর্তী প্রবন্ধে আল্লাহ তায়ালা যে দেহ থেকে পবিত্র, আল্লাহ তায়ালার দেহ সাব্যস্ত করা সুষ্পষ্ট শিরকী, এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা প্রকাশ করা হবে ইনশআল্লাহ।

১-
ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ
অতঃপর তিনি আরশে সমাসিন হন {সূরা হাদীদ-৩}

২-
قوله تعالى {وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ}
আর যখন আমার বান্দা আমাকে ডাকে, তখন নিশ্চয় আমি তার পাশেই। আমি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেই যখন সে ডাকে। {সূরা বাকারা-১৮৬}

৩-
قوله تعالى {وَنَحنُ أَقرَبُ إِلَيهِ مِن حَبلِ الوَرِيدِ} [ق 16]
আর আমি বান্দার গলদেশের শিরার চেয়েও বেশি নিকটবর্তী। {সূরা কাফ-১৬}

৪-
فَلَوْلا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ (83) وَأَنْتُمْ حِينَئِذٍ تَنْظُرُونَ (84) وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لا تُبْصِرُونَ (85)
অতঃপর এমন কেন হয়না যে, যখন প্রাণ উষ্ঠাগত হয়। এবং তোমরা তাকিয়ে থাক। এবং তোমাদের চেয়ে আমিই তার বেশি কাছে থাকি। কিন্তু তোমরা দেখতে পাওনা {সূরা ওয়াকিয়া-৮৩,৮৪,৮৫}

৫-
{ وَللَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّواْ فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ } [البقرة-115]
পূর্ব এবং পশ্চিম আল্লাহ তায়ালারই। সুতরাং যেদিকেই মুখ ফিরাও, সেদিকেই রয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞাত {সূরা বাকারা-১১৫}

৬-
قوله تعالى { وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَمَا كُنتُمْ } [ الحديد - 4 ]
তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন {সূরা হাদীদ-৪}

৭-
وقال تعالى عن نبيه : ( إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا (التوبة من الآية40
যখন তিনি তার সাথীকে বললেন-ভয় পেয়োনা, নিশ্চয় আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন {সূরা হাদীদ-৪০}

৮-
قوله تعالى مَا يَكُونُ مِن نَّجْوَى ثَلاثَةٍ إِلاَّ هُوَ رَابِعُهُمْ وَلا خَمْسَةٍ إِلاَّ هُوَ سَادِسُهُمْ وَلا أَدْنَى مِن ذَلِكَ وَلا أَكْثَرَ إِلاَّ هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا ثُمَّ يُنَبِّئُهُم بِمَا عَمِلُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ( المجادلة – 7 )
কখনো তিন জনের মাঝে এমন কোন কথা হয়না যাতে চতুর্থ জন হিসেবে তিনি উপস্থিত না থাকেন, এবং কখনও পাঁচ জনের মধ্যে এমন কোনও গোপন কথা হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি উপস্থিত না থাকেন। এমনিভাবে তারা এর চেয়ে কম হোক বা বেশি, তারা যেখানেই থাকুক, আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন। অতঃপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে অবহিত করবেন তারা যা কিছু করত। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন {সূরা মুজাদালা-৭}

৯-
وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ
আল্লাহ তায়ালার কুরসী আসমান জমিন ব্যাপৃত {সূরা বাকারা-২৫৫}

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান হলে আকাশের দিকে কেন হাত উঠিয়ে দুআ করা হয়?

আদবের জন্য। যদিও আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান। তিনি ডান দিকেও আছেন, বাম দিকেও আছেন, উপরেও আছেন, নিচেও আছেন। সামনেও আছেন। বাম দিকেও আছেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার শান হল উঁচু, তাই আদব হিসেবে উপরের দিকে হাত উঠিয়ে দুআ করা হয়।
যেমন কোন ক্লাশরুমে যদি লাউডস্পীকার ফিট করা হয়। চারিদিক থেকে সেই স্পীকার থেকে শিক্ষকের আওয়াজ আসে। তবুও যদি কোন ছাত্র শিক্ষকের দিকে মুখ না করে অন্যত্র মুখ করে কথা শুনে তাহলে শিক্ষক তাকে ধমক দিবেন। কারণ এটা আদবের খেলাফ। এই জন্য নয় যে, অন্য দিক থেকে আওয়াজ শুনা যায় না। তেমনি আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান থাকা সত্বেও উপরের দিকে মুখ করে দুআ করা হয় আল্লাহ তায়ালা উুঁচু, সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই আদব হিসেবে উপরের দিকে হাত তুলে দুআ করা হয়।

জিবরাঈল উপর থেকে নিচে নেমে আসেন মানে কি?

এর মানে হল-যেমন পুলিশ এসে কোন অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে কারণ বলে যে, উপরের নির্দেশ। এর মানে কি পুলিশ অফিসার উপরে থাকে? না সম্মান ও ক্ষমতার দিক থেকে যিনি উপরে তার নির্দেশ তাই বলা হয় উপরের নির্দেশ? তেমনি আল্লাহ তায়ালা ফরমান নিয়ে যখন জিবরাঈল আসেন একে যদি বলা হয় উপর থেকে এসেছেন, এর মানেও সম্মানসূচক ও পরাক্রমশালীর কাছ থেকে এসেছেন। তাই বলা হয় উপর থেকে এসেছেন। এই জন্য নয় যে, আল্লাহ তায়ালা কেবল আরশেই থাকেন।

আল্লাহ তায়ালা কি সকল নোংরা স্থানেও আছেন? নাউজুবিল্লাহ

এই উদ্ভট যুক্তি যারা দেয় সেই আহমকদের জিজ্ঞেস করুন। তার কলবে কি দু’একটি কুরাআনের আয়াত কি সংরক্ষিত আছে? যদি বলে আছে। তাহলে বলুন তার মানে সীনায় কুরআনে কারীম বিদ্যমান আছে। কারণ সংরক্ষিত সেই বস্তুই থাকে, যেটা বিদ্যমান থাকে, অবিদ্যমান বস্তু সংরক্ষণ সম্ভব নয়। তো সীনায় যদি কুরআন বিদ্যমান থাকে, সেটা নিয়ে টয়লেটে যাওয়া কিভাবে জায়েজ? কুরআন নিয়েতো টয়লেটে যাওয়া জায়েজ নয়। তখন ওদের আকল থাকলে বলবে-কুরআন বিদ্যমান, কিন্তু দেহ থেকে পবিত্র কুরআন। তেমনি আমরা বলি আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু তিনি দেহ থেকে পবিত্র। সেই হিসেবে সর্বত্র বিরাজমান। সুতরাং কুরআন যেমন সীনায় থাকায় সত্বেও টয়লেটে যেতে কোন সমস্যা নেই। কুরআনে কারীমের বেইজ্জতী হয়না, সীনায় সংরক্ষিত কুরআনের দেহ না থাকার কারণে, তেমনি আল্লাহ তায়ালার দেহ না থাকার কারণে অপবিত্র স্থানে বিদ্যমান থাকাটাও কোন বেইজ্জতীর বিষয় নয়।
যেই সকল নির্বোধের দল আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমানতাকে অস্বিকার করে আল্লাহ তায়ালাকে নির্দিষ্ট স্থানে সমাসিন বলে আল্লাহ তায়ালার সত্তার বেয়াদবী করছে ওদের অপপ্রচার থেকে, বাতিল আক্বিদা থেকে আমাদের আল্লাহ তায়ালা রক্ষা করুন। আমীন।

Author Name

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.